বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাটকগুলোর মধ্যে সৈয়দ শামসুল হকের লেখা ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ একটি অনন্য সৃষ্টি। এই নাটকটি শুধু একটি নাটক নয়, এটি একদিকে আমাদের ইতিহাসের এক গৌরবময় অধ্যায়কে তুলে ধরে, অন্যদিকে মুক্তির চেতনা ও সংগ্রামের কথা বলে। নাটকটি নূরলদীন নামে এক কৃষক বিদ্রোহীর জীবনকে কেন্দ্র করে রচিত, যিনি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলেন।

নূরলদীনের সারাজীবন

নাটকের পটভূমি

‘নূরলদীনের সারাজীবন’ নাটকটির পটভূমি তৈরি হয়েছে উনবিংশ শতকের বাংলার কৃষক বিদ্রোহের ওপর ভিত্তি করে। বিশেষ করে ১৭৮৩ সালের ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ এবং নূরলদীনের নেতৃত্বে সংঘটিত দিনাজপুরের কৃষক বিদ্রোহ নাটকের মূল প্রেক্ষাপট। ব্রিটিশ শাসনের নিপীড়ন, জমিদার ও মহাজনদের অত্যাচার, কৃষকদের দুর্দশা—এসবই নাটকের পটভূমিকে গভীর করে তুলেছে। এই নাটক মূলত আমাদের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের একটি প্রতীকী উপস্থাপনা যেখানে অত্যাচারী শক্তির বিরুদ্ধে এক সাধারণ মানুষের লড়াই চিত্রিত হয়েছে।

বিষয়বস্তু

নাটকটি মূলত কৃষকদের দুর্দশা ও তাদের বিদ্রোহের চিত্র তুলে ধরে। ব্রিটিশ শাসকদের অন্যায় করনীতি, জমিদারদের অত্যাচার এবং সাধারণ মানুষের উপর চালানো শোষণের বিরুদ্ধে নূরলদীন ছিলেন এক অকুতোভয় সংগ্রামী। নাটকের প্রতিটি পরতে পরতে ফুটে উঠেছে নির্যাতিত মানুষের কান্না, সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের চিত্র।

এই নাটকে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ এবং নিপীড়িত মানুষের অধিকারের দাবি বিশেষভাবে প্রাধান্য পেয়েছে। নাটকটি শুধু একটি ঐতিহাসিক কাহিনি নয়, বরং এটি আজও আমাদের সমাজের অন্যায় ও শোষণের বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টি করে।

চরিত্র

নূরলদীন – নাটকের প্রধান চরিত্র, যিনি একজন সংগ্রামী কৃষক নেতা। তিনি নিপীড়িত কৃষকদের সংগঠিত করে ব্রিটিশ ও জমিদারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন।

ফকির মজনু শাহ – বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের আরেক উল্লেখযোগ্য চরিত্র, যিনি ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং কৃষকদের প্রেরণা যুগিয়েছেন।

ব্রিটিশ শাসক ও জমিদাররা – নাটকের অন্যতম প্রতিপক্ষ, যারা সাধারণ মানুষকে শোষণ করে এবং তাদের ওপর অত্যাচার চালায়।

সাধারণ কৃষক ও বিদ্রোহীরা – নাটকের প্রাণ, যারা নূরলদীনের নেতৃত্বে নিজেদের অধিকারের জন্য লড়াই করে।

উপসংহার

‘নূরলদীনের সারাজীবন’ শুধু একটি নাটক নয়, এটি আমাদের ঐতিহাসিক সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি। এটি আমাদের স্বাধীনতার মূল্য বোঝায় এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রেরণা জোগায়। সৈয়দ শামসুল হকের এই নাটক আজও আমাদের জাতীয় চেতনাকে উজ্জীবিত করে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নতুন করে মনে করিয়ে দেয়।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন